বগুড়ায় বুধবার নতুন করে যে ৭জন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন তাদের মধ্যে সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলার দু’জন ছাড়া অন্য ৫ জনের শরীরে ন্যূনতম কোন উপসর্গ নেই। তাছাড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার বি-ব্লক এলাকায় এমন এক গৃহবধু করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন যিনি স্বজনদের ছাড়া অন্য কারো সংস্পর্শে যাননি।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো তার স্বামী একজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিটিভ। প্রতিদিন বাইরে গেলেও তার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ এসেছে।
সর্দি, জ্বর, কাশি, গলাব্যথা কিংবা শ্বাসকষ্টের মত কোন উপসর্গ ছাড়াই জেলার নন্দীগ্রাম, শাজাহানপুর, দুপচাঁচিয়া ও সোনাতলা উপজেলা এবং বগুড়া শহরের বাসিন্দা ৫ জনের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাটি স্থানীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের রীতিমত চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। তাদের মতে কোন লক্ষণ ছাড়াই করোনাভাইরাসে সংক্রমণের ঘটনাটি এই বার্তাই দিচ্ছে যে, বগুড়ায় প্রাণঘাতি ওই ভাইরাসটির কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে গেছে। ফলে জেলাবাসী যদি এখনই সতর্ক না হন, তাহলে হলে আগামীতে আক্রান্তের হার বাড়তেই থাকবে।
বগুড়ার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মুস্তাফিজুর রহমান তুহিন বুধবার রাতে জেলার নন্দীগ্রমের ১২ বছরের এক কন্যা শিশু এবং শাজাহানপুরের এক গৃহবধূসহ, উল্লেখিত সাত উপজেলার একজন করে ৭ জনের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার তথ্য দেন। এ নিয়ে জেলায় এ পর্যন্ত ১২ জন করোনায় আক্রান্ত হলেন।
স্বাস্থ্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২২ এপ্রিলের আগ পর্যন্ত আরও যে ৫জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের প্রত্যেকের মধ্যে জ্বর, কাশি ও শ্বাস কষ্টের মত উপগর্স ছিল। যে কারণে পজিটিভ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর পরই তাদেরকে করোনা আইসোলেশন ইউনিট মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আর গত ২২ এপ্রিল নতুন করে আক্রান্ত ৭জনের মধ্যে উপসর্গবিহীন পাঁচজনকে হাসপাতালে না নিয়ে বাড়িতে আলাদা রেখেই চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অবশ্য জ্বরসহ অন্যান্য উপসর্গ থাকায় সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলায় আক্রান্ত দু’জনকে বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে পাঠানো হবে।
নন্দীগ্রামে ১২ বছর বয়সী যে কন্যা শিশুর করোনা পজিটিভ এসেছে তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন মণ্ডল জানান, ওই শিশু এবং তার বাবা-মা ঢাকায় থাকতেন। কিছুদিন আগে বাড়ি ফিরলে তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। এরপর সতর্কতার জন্য গত ১৯ এপ্রিল তাদের তিনজনেরই নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বুধবার রাতে জানানো হয় ওই তিনজনের মধ্যে শুধু ১২ বছরের মেয়েটি করোনা পজিটিভ।
ডা. মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন মণ্ডল বলেন, ওই মেয়েটি সম্পূর্ণ সুস্থ আছে। তার কোন সমস্যা নেই। যে কারণে তাকে বাড়িতে আলাদা কক্ষে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
শাজাহানপুর উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোতারব হোসেন জানান, উপজেলার বি-ব্লক এলাকার পেশায় মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিটিভ এক ব্যক্তি কিছুদিন আগে গায়ে হাল্কা জ্বর অনুভব করেন। এরপর তিনি এবং তার স্ত্রী দু’জন গত ২১ এপ্রিল বগুড়ায় মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে গিয়ে নমুনা দিয়ে আসেন। বুধবার রাতে ফলাফলে জানা গেল ওই রিপ্রেজেন্টিটিভ নেগেটিভ হলেও তার স্ত্রী করোনা পজিটিভ।
ডা. মোতারব হোসেন বলেন, ‘আমরা হিস্ট্রি নিয়ে দেখেছি ওই গৃহবধূ তার স্বজনদের ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে মেশেননি। আর তিনি স্বামীর সঙ্গেই থেকেছেন।’
সোনাতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এহিয়া কামাল জানান, তাদের ৪৫ বছর বয়সী এক স্বাস্থ্য কর্মী প্রায় ৩ মাস আগে ঢাকায় গিয়েছিলেন। এরপর তিনি বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। চারদিন আগে ওই স্বাস্থ্যকর্মী হাল্কা গলাব্যথার কথা বলেন। তখন তার নমুনা পরীক্ষা করলে পজিটিভ আসে।
তিনি বলেন, ‘রিপোর্ট আসার পর ওই স্বাস্থ্যকর্মীর পরিবারসহসহ আশপাশের অন্তত ৩৬ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ‘
দুপচাঁচিয়ায় ৬০ বছর বয়সী যে ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়েছে তিনি পাশের উপজেলা আদমদীঘিতে ইতিপূর্বে করোনায় আক্রান্ত এক ব্যক্তির আত্মীয়। দুপচাঁচিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আব্দুল কুদ্দুস মণ্ডল জানান, ওই ব্যক্তির কোন উপসর্গ নেই। তিনি সুস্থ। শুধু মাত্র ইতিপূর্বে করোনা পজিটিভ এক ব্যক্তির আত্মীয় হওয়ার কারণে তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল।
বগুড়া শহরের সবুজবাগ এলাকার ৪০ বছর বয়সী যে ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তার তেমন কোন উপগর্স ছিল না বলে জানিয়েছেন বগুড়া সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সামির হোসেন মিশু। তিনি বলেন, যেহেতু তার কোন জটিলতা নেই সে কারণে তাকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে আশ-পাশের কয়েকটি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে।
সারিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এস এম মাহমুদুর রশিদ জানান, তার উপজেলার ২৮ বছর বয়সী যে যুবকের পজিটিভ এসেছে তিনি ঢাকার একটি মেসে থেকে বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। গত ২০ মার্চ তিনি সারিয়াকান্দিতে নিজ বাড়িতে ফিরলে তাকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। গত ১৯ এপিল জ্বরের লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে আসলে তার নমুনা সংগ্রহ করে পজিটিভ পাওয়া যায়। ডা. এস এম মাহমুদুর রশিদ জানান, ওই যুবক এলাকার ৩ শিক্ষার্থীকে পড়াতেন। তাদেরস্বজন আশপাশের ২২জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। আর ওই যুবককে বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে পাঠানো হবে।
ধুনটের ২২ বছর বয়সী যে যুবক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তিনি গাজীপুরে একটি কারখানায় কর্মরত ছিলেন। কয়েকদিন আগে ধুনটে নিজ বাড়িতে ফেরার পর তাকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। দু’দিন আগে চোখ লাল হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়েছিলেন। তখন তার নমুনা সংগ্রহ করা হলে ২২ এপ্রিল জানানো হয় তিনি করোনা পজিটিভ। ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হাসানুল হাসিব জানান, যেহেতু তার উপসর্গ আছে তাই তাকে বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে পাঠানো হবে।
বগুড়ার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মুস্তাফিজুর রহমান তুহিন জানিয়েছেন, সার্বিক পরিস্থিতি দেখে এটা বলাই যায় যে, বগুড়ায় কমিউনিটি পর্যায়ে করোনার ট্রান্সমিশন ঘটে গেছে। এজন্য আমাদের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন থাকতে হবে। উপসর্গবিহীন করোনা পজিটিভ ৫জনকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আলাদা ঘরে রেখে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব এবং তিন দিন পর পর নমুনা সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে তাদেরকেই কেবল বাড়িতে রাখা হচ্ছে। তবে প্রয়োজন হলে আমরা অবশ্যই তাদেরকে হাসপতালেও স্থানান্তর করতে পারি।’