এম.ইউ শাকিল, নিজস্ব প্রতিনিধি ॥
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শেষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পরীক্ষায় পাশ করার পর আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে আবেদন করি। একটি গ্রুপ অব কোম্পানির চাকরি ছেড়ে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। কালো কোট-গাউন পড়ে আদালতে যাবো অহর্নিশ এ স্বপ্নে বিভোর থাকি। গরিব-দু:খী অসহায় মানুষকে আইনী সহায়তা দিবো, তাদের ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে সংগ্রাম করবো- এমন কত কত স্বপ্ন বুনি কিন্তু আমার সব স্বপ্নের সলিল সমাধি হচ্ছে। বাবা’র স্বপ্নপূরণে আমি অটল। স্বপ্নপূরণের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু নিয়মিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় শুধুমাত্র আইনজীবী হিসেবে স্বীকৃতি পেতেই আমার জীবন থেকে চলে গেছে চার বছর। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার পরেও নিজের সংসার থেকে শুরু করে দেশ ও সমাজের জন্য কোন ভূমিকা রাখতে পারছিনা। এখনো বাবা’র কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিতে হয়।
২০১৭ সালে আইনজীবী তালিকাভুক্ত হওয়ার রেজিষ্ট্রেশন পেলেও ভাগ্যদোষে ওই বছর এম.সি.কিউ পরীক্ষা দিতে পারিনি। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে এম.সি.কিউ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। তিন বছর অপেক্ষার পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পরীক্ষা দিলাম এম.সি.কিউ, এতো কঠিন পরীক্ষায় আল্লাহর রহমতে পাশও করলাম। এখন লিখিত পরীক্ষার পালা, কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এই পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এদিকে বাবা-এর স্বপ্ন ছিল ছেলে বড় হয়ে আইনজীবী হবে। আমার বাবা একজন আইনজীবী সহকারী হওয়ার সুবাদে শৈশব থেকেই সহজাতভাবে আইনের প্রতি ভালোলাগা, পরবর্তিতে যেটা ভালবাসায় রূপ নেয়।
অন্যদিকে উৎসাহিত করার বিপরীতে এ পেশায় আসতে নিরুৎসাহী করেছেন স্থানীয় বার এসোসিয়েশনের কতিপয় সদস্য। ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর নিয়মিত কোর্টে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা তো রয়েছেই। এ অবস্থায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কি যে মানবেতর জীবন-যাপন করছি যা বলে বুঝাতে পারবো না। কিন্তু এই দুঃখ ও কষ্টের কথা শুধুমাত্র শিক্ষানবিশ আইনজীবীরাই বুঝবেন ।
সোমবার ( ১৩ জুলাই ) সকালে একান্ত সাক্ষাতকারে আবেগআপ্লুত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষানবিশ আইনজীবী আরিফ আজাদ ( ছদ্মনাম)।
তিনি আরো বলেন, নিষেধাজ্ঞা থাকায় নিয়মিত কোর্টে যেতে পারছিনা । আমাদের বারে কয়েক বছর পূর্বে ১৯ জন শিক্ষানবিশকে টাউট আখ্যা দিয়ে বারের দেওয়ালে নাম লিখে দিয়েছিল । এর মধ্যে কয়েকজন গতবার বার কাউন্সিল কর্তৃক আইনজীবী তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও স্থানীয় বার তাদের গ্রহণ করেনি। এই শঙ্কায় আমি কোর্টে না যাওয়ায় আমার কোন আয় নেই। এ অবস্থায় অন্য কোন পেশাতেও যেতে পারছিনা। চার ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। আমার তিনটি বোনের মধ্যে ছোট বোনটির এক ছেলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। গত দুই বছর আগে তার স্বামী মারা গেছেন। এ অবস্থায় ছেলে নিয়ে তিনিও এখন আমাদের বাড়িতেই থাকেন। আমার বাবার বর্তমান বয়স ৬৫বছর। তিনি তিনবার স্ট্রোক করেছেন, তারপরও তিনি প্রতিমাসে যা ইনকাম করেন তা দিয়েই আমাদের সংসার কোনমতে চলছে। আমার স্ত্রী ও চার বছরের মেয়েও আছে ওই একই সংসারে। মেয়ে ও স্ত্রীকে নিজের টাকায় কোন কিছু কিনে দিতে পারিনা। আইনজীবী হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ায় শ্বশুরবাড়িতে যেতে লজ্জা লাগে। বিধবা বোনের পাশে গিয়ে সান্তনার বাণী দিতে পারিনা। আমাকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সমাজের লোকজন। দিন দিন আমি যেন নিজেকে সংকীর্ণ করে ফেলছি। আমার পৃথিবীটা যেন ছোট হয়ে এসেছে। গরিব-দু:খী, অসহায় ও নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় আমরণ লড়ায়ের প্রত্যয় আজো অধরা।