লেখক : ইসমাইল হোসেন
নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সিরাজগঞ্জ প্রতিদিন।
রাত আনুমানিক দুটো। ঘুমাতে যেতে বিছানার কাছে গিয়ে সাধারণত যা করি না, সেই কাজটা করে ফেললাম। মোবাইলটা হাতে নিয়ে সোসাল মিডিয়ার পাতায় চোখ বুলালাম। প্রথমেই যে পোস্ট পড়ল। তা দেখে চোখের ভ্রম মনে করলাম। আবারও চোখটা ঘুরিয়ে এফবি’র পাতায় রাখলাম। না, ভুল, না ভ্রম। ঠিকই দেখেছি। এতো কঠিন এক সত্য। পরিস্কার ভাষায় লেখা রাত ১২.৪৫ মিনিট। রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে জীবনে শেষবারের মতো নিশ্বাস ছেড়ে পৃথিবী থেকে চলে গেলেন রেজাউল হক চৌধুরী মোশতাক। ৭১ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ওপারে চলে গেলেন। মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। চোখ থেকে ঘুম কেটে গেল। মোশতাক ভাইয়ের সাথে আমার কোন রক্তের বন্ধন ছিল না। তিনি যমুনার পাড়ের মানুষ ছিলেন না। ছিলেন অনেক দূরের বিশাল সমুদ্রের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার। বয়সে আমার চেয়ে বয়স আট-নবছর বেশি। পৃথিবীতে মুখোমুখি হয়েছি জীবনে একবার-দুবার। আমাকে তার মনে থাকতেও পারে আবার নাও পারে। তবু ভেতর থেকে একটা শূন্যতা অনুভব করলাম। সেই শুন্যতায় বাকী রাত আমার দুচোখের পাতা এক করতে দেয়নি। কেন জানি বার বার মনে হচ্ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পরতে পরতে যাদের অবদান। একে একে তারা সবাই চলে যাচ্ছে।
আমার কাছে এবং হয়তো আরও অনেকের কাছেই তিনি আমাদের জাতির জীবনের ঐতিহাসিক সংগ্রামের পথের অসাধারণের ভুমিকার একজন। এই জাতীয় চেতনার টানটাই আমাকে মোশতাক ভায়ের সাথে রক্তের বন্ধনকে ছাপিয়ে মানসিকভাবে নৈকট্যে নিয়ে এসেছিল। সেকারণেই হয়তো বাকী রাত দুচোখের পাতা হয়নি এক। থেকে গেলাম নির্ঘুম।
রেজাউল হক মোশতাক চৌধুরী ছিলেন ৬৭-৬৮ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক। হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালের প্রস্তাব ও পরামর্শে। ৬৮-৬৯ সালে ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সভাপতি। ৭০-৭১ সালে ছাত্রলীগ এর সহ-দফতর সম্পাদক। স্বাধীনতার পর ৭২-৭৩ সালে ছাত্রলীগ (বৈ.স.) এর দপ্তর সম্পাদক। তারপর থেকে মারা যাবার আগে পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে ছিলেন না। ছিলেন না সক্রিয়। ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক। বয়সের হিসেবে একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে তিনি ছিলেন দেশের জেষ্ঠ নাগরিকদের একজন। এই মানুষটিই জীবনে বেড়ে ওঠার সময় জীবনের প্রারম্ভিক সময়ে ছিলেন তোজেদীপ্ত এক যুবক। তারুণ্যে উদ্ভাসিত।
লাহোরে ঘোষিত শেখ মুজিবের ৬ দফা আন্দোলনে দেশ যখন চরম ভাবে আন্দোলিত। আগরতলা ষড়যন্ত্রমূলক মামলার মধ্যদিয়ে মুজিব ভাই যখন জনগনের হৃদয়ের মনিকোঠায়। যাকে কেন্দ্র করে বাঙালী জাতিয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে। যাকে ঘিরে বাঙালি জাতি একটি স্বাধীন রাষ্ট প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। যিনি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বাঙালী জাতিসত্ত্বার প্রতীক। অধিকার আদায়ের মহানায়ক। নেতা কর্মীদের কাছে যিনি হয়ে উঠেছিলেন মুজিব ভাই। কেউ বলতেন বঙ্গশার্দুল। কেউ বলতেন সিংহশার্দুল। সেই সময় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধুর অনুসারী মোশতাকের কাছে এসব সম্বোধন পছন্দ হলো না। মোহন দাস করম চাদ গান্ধী, মহাত্মা ও বাপু, সুভাষ বসুকে নেতাজি, পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে কায়দে আজম, আবুল কাসেম ফজলুল হককে শেরে বাংলা। অথচ বাঙালী স্বাধীকার, স্বাধীনতার মহানায়ক মুজিব ভাইকে বঙ্গশার্দুল, সিংহ শার্দুল নয় আরও যুৎসই সম্বোধন হতে হবে।
তরুণ ছাত্রনেতা ছাত্রলীগের প্যাডে লিখে ফেললেন ‘সারথি’ ছদ্মনামে ‘আজব দেশ’ নিবন্ধ। নিবন্ধটি প্রকাশিত হল ছাত্রলীগের বুলেটিনে। প্রকাশিত হল প্রতিধ্বনি পত্রিকায়। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার জন্ম নেয়া মোশতাক চৌধুরী ওই নিবন্ধে প্রথম ব্যবহার করলেন জনগনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান নামের আগে একটি শব্দ ‘বঙ্গবন্ধু’।
আগরতলা ষড়যন্ত্রমুলক মামলা থেকে জনতার দাবীর মুখে আইয়ুব শাহী শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী জনতার মুজিবকে লাখে ছাত্রজনতা সংবর্ধিত করলো রেসকোর্স ময়দানে (এখনকার সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যান)। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে সেই ঐতিহাসিক গণজমায়েতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসু সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ জনতার মুজিবকে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংবধির্ত করলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে।
সেদিন থেকেই মুজিব ভাই হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু। কোটি বাঙালীর হৃদয়ের ভালোবাসা নিঙরানো বঙ্গবন্ধু সম্বোধন। সেই ‘আজব দেশ’ বুলেটিনে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্বোধনের লেখক ছাত্রনেতা রেজাউল হক চৌধুরী মোশতাক ভাইকে কেমন করে ভুলে থাকি; একজন বাঙালি হিসেবে। উনি তো আমার দেহ মনে রক্তের বাঁধনের চেয়ে শক্ত বাঁধন বাঙালির জাতিসত্ত্বার চেতনা বিকাশের আন্দোলনের পথের এক ‘সারথি’। কেমনে যাই সেকথা ভুলে। ওই লোকটির শেষ নিশ্বাস ত্যাগের সংবাদ পড়ে তাই হৃদয়ের বামকোনে জেগে ওঠে ব্যথা। সৃষ্ট হয় শূণ্যতার। . . . বাকী রাত আর ঘুম এলো না। দুচোখের পাতা আর হলো না এক। রাত ভোর হলো আযানের ধ্বনি ভেসে এলো। ব্যথিত হৃদয়ের ভেতর থেকে আওয়াজ বেড়িয়ে এলো-সালাম হে মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালীর জাতির গর্বিত সন্তান মোশতাক ভাই। ওপারে যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন, শান্তিতে থাকুন।